ঘুম ভাঙল তারক দার ডাকে। সুব্রত, চল উঠে পড় চা খেতে যাবো। দেখি, সকাল হয়েছে পাখিরা ও ডাকা শুরু করেছে। হাল্কা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব, বেশ মনোরম আবহাওয়া, হাল্কা একটা গরমের জামা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। একটু হাঁটা হাটি করে চা খেয়ে আবার হোটেলে। এরই মধ্যে ফিরে এসে দেখি আমাদের পোর্টার ভাই-রা এসে পৌঁছেছে হোটেলে। আলাপ হলও একজন লক্ষ্মী ভাই, আর একজন তুলারাম। ওদের সকালের খাওয়ার দিয়ে নিজেরাও খাওয়ার খেয়ে নিয়ে স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিলাম, পোর্টার ভাই-রা আগেই চলে গেছে দলের মালপত্র নিয়ে। সাথে আমাদের গাড়ি ঠিক করে রাখার জন্য। গাড়ির আড্ডায় এসে আমাদের নির্ধারিত সীটে বসে পড়লেও আমাদের গাড়ির চালক বন্ধু টির দেখা নেই। কারন জানলাম তার এখনো গাড়ি ভরেনি তাই সে এখন যাবে না। প্রায় ১ ঘণ্টা পর তার গাড়ি ভরতে-ই গাড়ি ছেড়ে দিল। আমরা এখন চলেছি ভাগীরথী নদীকে আমাদের ডান দিকে রেখে। কিছু ক্ষণ চলার পর আবার বাম দিকে।
গাড়ি যত পাহাড়ের উপরের দিকে উঠছে প্রকৃতি দেবী ও নিজের রং ও রূপকে উজাড় করে ধরা দিচ্ছে আমার সামনে। পাহাড়ের সেই রূপ যে দেখেছে তার ডাক উপেক্ষা আর কেউ করতে পারেনি। সে যেই হোক। পোর্টার ভাইয়ে ডাকে ধ্যান ভাঙ্গল, বলল দাদা ইহা সে হি মিট্টি কা তেল উঠানা হ্যা। ড্রাইভার কো রুক-নে কে লিয়ে বোলো। বলা হোল, গাড়ি দাঁড়িয়ে ও গেলো যথা স্থানে।
সাথে উপরি পাওনা হয়ে গেলো ওনার দোকানেই গরম চায়ের উষ্ণ অভ্যর্থনা। দোকান টি বেস বড় সামনের দিকে অনেক টা খোলা। আমার সদস্যরা দোকানের সামনেই বসে পড়েছে চেয়ার টেবিলে গায়ে রোদ লাগানোর জন্য, আর আমি!! একটু তারকাটা টাইপের, আমার অভ্যাস স্থানীয় মানুষের সাথে আলাপ করা, ওদের সাথে কথা বলা, ওদের কে জানা, আমার বেশ ভালোই লাগে, তাই আমি তখন ঐ দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়লাম গরম চায়ের আমেজ নিতে। দোকানের ঐ ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের সাথে ঠাণ্ডা হাওয়া বেশ লাগছিল, আর আশে পাশের মাথা তুলে দেখছি উঁচু পাহাড়ের মাথায় নতুন বরফের আস্তরণ। আর রাস্তা দিয়ে ছোটো ছোটো বাচ্ছা দের স্কুলের পোশাকে খেলতে খেলতে স্কুলে জীবনের দিকে ছুটে চলা দেখছি। আমার সাথীরা দোকান থেকে একটু আগেই একটা ছোটো গ্রাম টাকে দেখতে গেছে, দুঃখিত নাম জানি না, কারন আমি যাই নি। আমি তখন নিজের মানশিক ধাক্কা থেকে উঠার চেষ্টা করেচলেছি, আর ঐ চায়ের দোকানের মালকিনের সাথে গল্প করছি আর তার কাঠের উনুনকে আমার নিজের সাধ্য মত জ্বালিয়ে রাখার চেস্টা করছি, উনুনে একটু একটু কাঠের জোগান দিয়ে। উনি তখন আলুর পকোড়া ভাজতে ব্যাস্ত। গরম পকোড়া খবরের কাগজের টুকরো তে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন ও। আমি ও সে গুলোকে উদর পূর্তি করছি, আর কেরসিন তেলের অপেক্ষা করছি। তুলারাম এসে বলল দাদা ৪০০/- রুপিয়া দো। আমি উত্তর দিলাম কিতনা উঠায়া তেল?? উত্তর পেলাম ১০ লিটার। বল্লাম ইয়েতো কাফি হ্যা। লেকিন ঠিকসে দাম শুনা তো?? বলে, হ্যা আপ প্যাসা দিজিয়ে, তাও ৫০০/- নোট দিলাম, কিছু পরেই আমাকে অবাক করে ১০০/- টাকা ফেরত করে দিল, সাথে কেরসিন তেলের মালিক ও হাজির। দেখলাম সেও কিছু বলছে না টাকা নিয়ে। মনে মনে ভাবলাম যাক বাঁচা গেছে। বিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমাকে অবাক করলো আমি কোথাও এতো কম দামে কেরসিন তেল পাইনি। অনেক পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেছি, কোথাও ৮০/- এর নীচে পাইনি। আবার ১০০/- টাকা লিটারে ও কিনেছি। কিন্তু কখনই ৪০/- টাকা লিটারে কিনিনি। ইতি মধ্যে আমার বাকি সদস্যরাও ফিরে এসেছে।
এইবার বিদায় জানানোর পালা। দোকানের মালকিন কে জিজ্ঞাসা করলাম কিত্না হুয়া?? উত্তর টা আমাকে বেস রীতিমত চমকে দিয়েছিল। ক্যায় দাদা!! আপ সে ভি প্যায়সা?? আপ যাইয়ে, ওর সাবধানী সে ওয়াপাস আইয়েগা। আমার কোন জোরই খাটলনা ওনার সামনে। এইটুকু সময়ের মধ্যেই আমাদের অজান্তেই আমাদের মধ্যে একটা এত সুন্দর আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে বুঝতে পারিনি। শুধু অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। জানি না আবার কোন দিন দেখা হবে কিনা কিন্তু উনি অবলীলায় আমাকে এক অদ্ভুত আত্মীয়তার বন্ধনে বেঁধে দিলেন। আমি গাড়িতে বসেও ওনার দিকে তাকিয়ে আছি, আর উনি হাঁসিমুখে আমাদের হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছেন। গাড়ি চলছে গঙ্গোত্রির উদ্দেশে, আর আমি ভাবছি যার সাথে আমি এতো দিন কাটালাম তাকে আমি আজ ও বুঝতে পারলাম না আর এই মহিলা এই কিছু সময়ের মধ্যে আমাকে এতো আপন করে নিলেন। সত্যিই অদ্ভুত আমরা, কাকেও চিনতে কয়েক শত বছর লেগে যায় আর কাকেও চিনতে কিছু মুহূর্তই যথেষ্ট।
গাড়ি চলছে, আর তুলারাম বলে যাচ্ছে কোনটা কি। কোন জায়গার নাম কি ইত্যাদি।
শুধু দেখে যাচ্ছি কিন্তু কিছু মাথায় ঢুকছে না, কারন আমার মাথায় তখন আর কিছু নেই, আছে শুধু ঐ দোকানদার মহিলা, আর তার আপন করে নেওয়া, তার আতিথেয়তা। এরই মধ্যে ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। গাড়ীর ঝাঁকুনিতে ঘুম টা ভেঙ্গে গেলো। গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখলাম জ্যাম। আর একটু মাথা তুলেতেই দেখতে পেলাম সুদর্শন পর্বতের। যে কোন রক্ত মাংসের মানুষ কে তার রূপ দিয়ে মোহিত করে দেওয়া তার কাছে কিছু না। কি তার রূপ। হটাৎ কে যেন বলল কি দেখছি রে?? শুধু বল্লাম সুদর্শন পিক। মনে হল সবারই জিজ্ঞাস্য হোল কই, কই, কই?? উত্তর দিলাম একদম সামনে সোজা সুজি উপরের দিকে দ্যাখ, ঐ যে, যে বরফে ঢাকা পাহাড় টাকে দেখা যাচ্ছে ওটাই সুদর্শন।
তার গুনমুগ্ধ রূপ নিয়ে আমার সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে আর পাহাড়ের পাক দণ্ডি বেয়ে পোঁছালাম গঙ্গোত্রীতে বিকেল ৪.০০ টে নাগাদ। ভাগীরথী নদীর তীরে হিন্দু ধর্মালম্বী দের পবিত্রতম তীর্থস্থল। ভারতবর্ষের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের উত্তরকাশী জেলার একটি শহর এই গঙ্গোত্রী। পৌরাণিক মতে রাজা ভগীরথের পূর্ব পুরুষদের পাপ থেকে উদ্ধারের জন্য দেবী গঙ্গা এই গঙ্গোত্রী তে নেমে এসেছিলেন। দেবীর এই ধরা ধামে আশার আগে রাজা ভগীরথ নাকি এইখানেই অনেক দিন তপস্যাও করেছিলেন। চারিদিকে কান ফাটানো কোলাহল, চিৎকার চেঁচামেচি, অগণিত গাড়ির হর্নের আওয়াজ। মনে হচ্ছে যেন গোটা ভারতবর্ষ আজ এক জায়গায়। তাদের নানা ভাষা নানা পরিধান তাদের এক এক জনকে এক একজনের থেকে আলাদা করছে। আর ঐ পরিধানই জানিয়ে দিচ্ছে ওনারা কোথা থেকে এসেছেন। আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল এক ফটকের সামনে। না পুলিশ আর গাড়ি যেতে দিচ্ছেনা, তাই আমাদের গাড়ি পথের এইখানেই ইতি।
এই জায়গায় আমি এই প্রথম বার, তাই জায়গার চারি দিকে চোখ বোলাতে বোলাতেই গাড়ি থেকে মাল পত্র নামিয়ে ১৪০০/- টাকা গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে হাঁটা শুরু করলাম এক চওড়া গলির রাস্তা দিয়ে। তার দুই দিকে অগুনতি পসরা। তাদের রং বেরঙের সামগ্রী সাজিয়ে বসে আছে গ্রাহকের আশায়। বেশ ভালোই লাগছিল দেখতে। বেশ কিছুটা হাঁটার পর গঙ্গোত্রী মন্দিরের ঠিক পিছনে বাম দিকে এক সিঁড়ি দিয়ে উঠেই কালি কমলি ধর্মশালা তেই আজ আমাদের রাত্রি বাস। বিশাল একটা ঘর পেলাম যাতে কিছু কম হলেও অনন্ত পক্ষে ২০ জন অনায়াসে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা সাত জনই ঐ ঘরেই ঢুকে পড়লাম ৬০০/- টাকার পরিবর্তে। সমস্ত মাল পত্র রেখে আবার বেরিয়ে পড়লাম একটু জায়গা টা কে একটু ভালো করে দেখে নিতে। কারন তাগিদ যেন আমারই বেশী ছিল। মন বিস্ন কিন্তু জায়গা টা আমার কাছে নতুন। তাই দেখা টা খুব জরুরী। বাকি সময় টা এই দিক সেদিক, এই গলি সেই গলি ঘুরতে ঘুরতেই চলে এলাম গঙ্গার তীরে (ভাগীরথী) বসে রইলাম বেশ কিছু ক্ষণ।
মনে পড়ে গেলো রাজ কাপুর সাহাবের আর রবীন্দ্রর জৈন সাহাবের বিখ্যাত সেই বিখ্যাত সিনেমা "রাম তেরি গঙ্গা ম্যাইলি" সত্যিই আজ গঙ্গা ম্যাইলি হয়েছে, সেটা আশে পাশে চোখ বোলালেই বোঝা যাচ্ছে। আমার বয়স যখন দুই বছর তখনের সিনেমাটা হলেও আমার খুব পছন্দের একটা সিনেমা। কারন, দুই জন বিখ্যাত মানুষ, প্রথম রাজ কাপুর সাহাব ও দ্বিতীয় রবীন্দ্রর জৈন সাহাব যেমন তার ডিরেকশান আর তার অসামান্য সব গান, কতবার দেখেছি সিনেমা টা তার হিসাব নেই। আর সিনেমাটা আমাদের হাওড়া থেকে শুরু হয়ে গঙ্গোত্রী হয়ে আবার শেষ হয় হাওড়া হয়ে গঙ্গাসাগরে এটাও একটা বড় পাওনা। কি জানি কোন পাহাড়ের, কোন কোনায় সুটিং করেছিলেন মনে মনে খুঁজতে লাগলাম। যাক আর কিছু বলছি না। সন্ধ্যায় ৭.৩০ মিনিটে গঙ্গা মায়ের আরতি, যেটা দেখার মতো।
আগে ১০ - ১৫ বার হরিদ্বারের গঙ্গা আরতি দেখেছি, কিন্তু গঙ্গোত্রী তে এই প্রথম বার। বেস ভালোই লাগলো। মনটাও বেস ফুরফুরে হয়ে গেল। এইবার আমাদের পেট মহাশয় ও হাঁকডাক শুরু করেছে। (বিশেষ : এই গঙ্গোত্রী জায়গা টি সম্পূর্ণ রকমের নিরামিষ, এইখানে মাছ, মাংস, ডিম তো দূর অস্ত পিঁয়াজ, রসুন ও পাওয়া যায় না) রাতে রুটি স্যালাড আর ফুলকপি আলুর সবজী, মন্দ লাগলো না। জায়গা টি সম্পূর্ণ নিরামিষ হলেও দাম বেশ চড়া। যাই হোক, ডিনার সেরে চলে এলাম আমাদের ঘরে। এরই মধ্যেই একজন নক দিচ্ছে আমাদের দরজায়, না না, ভুল ভাবছেন, সে আর কেউ না ইনি নিদ্রার দেবী। রাতে বেশ ঠাণ্ডা, তাই লেপ কম্বল নিয়ে ঐ মেঝেতে পাতা গদিতেই শুয়ে পড়লাম। কি জানি কি ভাবছিলাম, আর কখন ঘুমালাম।
বিশেষ :
১.দয়া করে অপেক্ষা করুন পরের সংখ্যার জন্য, খুব তাড়া তাড়িই প্রকাশ করবো।
২.আপনাদের মতামত জানার অপেক্ষায় রইলাম, আশা করি জানাবেন।
৩.যদি আমার লেখা ভালো লেগে থাকে তো সাবস্ক্রাইব করুন!! উপদেশ দিন, আরও ভালো লেখার ও উৎসাহ যোগান!!
২.আপনাদের মতামত জানার অপেক্ষায় রইলাম, আশা করি জানাবেন।
৩.যদি আমার লেখা ভালো লেগে থাকে তো সাবস্ক্রাইব করুন!! উপদেশ দিন, আরও ভালো লেখার ও উৎসাহ যোগান!!
ধন্যবাদ।